Saturday, April 30, 2016

প্রথম শ্রেণী হতে মাধ্যমিক পর্যন্ত পাঠ্য সকল ছড়া ও কবিতার সংকলন -৪

আষাঢ় 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 

নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে। 
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে। 
বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর, 
আউশের খেত জলে ভরভর, 
কালি-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ্ চাহি রে। 
ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে। 
ওই ডাকে শোনো ধেনু ঘনঘন, ধবলীরে আনো গোহালে। 
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে। 
দুয়ারে দাঁড়ায়ে ওগো দেখ দেখি 
মাঠে গেছে যারা তারা ফিরিছে কি? 
রাখালবালক কী জানি কোথায় সারা দিন আজি খোয়ালে 
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে। 
শোনো শোনো ওই পারে যাবে বলে কি ডাকিছে বুঝি মাঝিরে। 
খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে। 
পুবে হাওয়া বয়, কূলে নেই কেউ, 
দু কূল বহিয়া উঠে পড়ে ঢেও, 
দরদর বেগে জলে পড়ি জল ছল ছল উঠে বাজি রে। 
খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে। 
ওগো, আজ তোরা যাস নে গো, তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে। 
আকাশ আঁধার, বেলা বেশি আর নাহি রে । 
[সংক্ষেপিত] 




সংকল্প 
কাজী নজরুল ইসলাম
 

থাকব না ক বাদ্ধ ঘরে 
দেখব এবার জগৎটাকে 
কেমন করে ঘুরছে মানুষ 
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে। 
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে 
ছুটছে তারা কেমন করে, 
কিসের নেশায় কেমন করে 
মরছে যে বীর লাখে লাখে। 
কিসের আশায় করখে তারা 
বরণ মরণ যন্ত্রণাকে। 
কেমন করে বীর ডুবুরি 
সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে, 
কেমন করে দুঃসাহসী 
চলছে উড়ে স্বর্গপানে । 
হাউই চড়ে চায় যেতে কে 
চন্দ্রলোকের অচিনপুরে, 
শুনব আমি ইংঙ্গিত কোন্ 
মঙ্গল হতে আসছে উড়ে। 
পাতাল ফেড়ে নামব আমি 
উঠব আমি আকাশ ফুঁড়ে, 
বিশ্বজগৎদেখব আমি 
আপন হাতের মুঠোয় পুরে। 
[সংক্ষেপিত] 

কে? 
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
 

বল দেখি এ জগতে ধার্মিক কে হয়, 
সব জীবে দয়া যার, ধার্মিক সে হয়। 
বল দেখি এ জগতে সুখী বলি কারে, 
সতত আরোগী যেই, সুখী বলি তারে। 
বল দেখি এ জগতে বিজ্ঞ বলি কারে, 
হিতাহিত বোধ যার, বিজ্ঞ বলি তারে। 
বল দেখি এ জগতে ধীর বলি কারে, 
বিপদে যে স্থির থাকে, ধীর বলি তারে। 
বল দেখি এ জগতে মূর্খ বলি কারে, 
নিজ কার্য নষ্ট করে, মূর্খ বলি তারে। 
বল দেখি এ জগতে সাধু বলি কারে, 
পরের যে ভালো করে, সাধু বলি তারে। 
বল দেশি এ জগতে জ্ঞানী বলি কারে, 
নিজ বোধ আছে যার, জ্ঞানী বলি তারে। 


তুলনা 
শেখ ফজলল করীম
 

সাত শত ক্রোশ করিয়া ভ্রমণ জ্ঞানীর অন্বেষণে, 
সহসা একদা পেল সে প্রবীণ কোনো এক মহাজনে। 
শুধাল, “হে জ্ঞানী । আকাশের চেয়ে উচ্চতা বেশি কার? 
জ্ঞানী বলে “বাছা, সত্যের চেয়ে উঁচু নাহি কিছু আর।” 
পুনঃসে কহিল “পৃথিবীর চেয়ে ওজনে ভারী কী আছে?” 
জ্ঞানী বলে, “বাছা, নিষ্পাপ জনে দোষারোপ করা মিছে।” 
জিজ্ঞাসে পুনঃ, “পাথরের চেয়ে কী আছে অধিক শক্ত?” 
জ্ঞানী বলে, “বাছা,‍ সেই যে হৃদয় জগদীশ-প্রেম-ভক্ত।” 
কহিল আবার, “অনলের চেয়ে উত্তাপ বেশি কার?” 
জ্ঞানী বলে,“বাছা ঈর্ষার কাছে বহ্নিতাপও ছার ।” 
পুছির পথিক, “বরফের চেয়ে শীতল কি কিছু নাই?” 
জ্ঞানী বলে, “বাছা, স্বজন-বিমুখ হৃদয় যে ঠিক তাই ।” 
শুধাল সে জন, “সাগর হইতে কে অধিক ধনবান?” 
জ্ঞানী বলে, “বাছা, তুষ্ট হৃদয় তারো চেয়ে গরীয়ান।” 

এত হাসি কোথায় পেলে 
জসীমউদদীন
 

এত হাসি কোথায় পেলে 
এত কথার খলখলানি 
কে দিয়েছে মুখটি ভরে 
কোন বা গাঙের কলকলানি। 
কে দিয়েছে রঙিন ঠোঁটে 
কলমি ফুলের গুলগুলানি। 
কে দিয়েছে চলন-বলন 
কোন সে লতার দুলদুলানি। 
কাদের ঘরে রঙিন পুতুল 
আদরে যে টুইটুবানি। 

কে এনেছে বরণ ডালায় 
পাটের বনের বউটুবানি। 
কাদের পাড়ায় ঝামুর ঝুমুর 
কাদের আদর গড়গড়ানি। 
কাদের দেশের কোন সে চাঁদের 
জোছনা ফিনিক ফুলছড়ানি। 
তোমায় আদর করতে আমার 
মন যে হল উড়উড়ানি 
উড়ে গেলাম সুরে পেলাম 
ছড়ার গড়ার গড়গড়ানি। 


শিক্ষাগুরুর মর্যাদা 
কাজী কাদের নেওয়াজ
 

বাদমাহ আলমগীর- 
কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলবী দিল্লীর্ 
‌একদা প্রভাতে গিয়া 
দেখেন বাদশা-শাহাজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া 
ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে 
পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে, 
শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধূলি 
ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ সঞ্চারি অঙ্গুলি। 
শিক্ষক মৌলবী 
ভাবিলেন, আজি নিস্তার নাহি, যায় বুঝ তাঁর সবি। 
দিল্লীপতির পুত্রের করে 
লইয়াছে পানি চরণের পরে, 
স্পর্ধার কাজ, হেন অপরাধ কে করেছে-কোন কালে। 
ভবিতে ভাবিতে চিন্তার রেখা দেখা দিল তাঁর ভালে। 
হঠাৎ কী ভাবি উঠি 
কহিলেন, আমি ভয় করি নাক, যায় যাবে শির টুটি, 
শিক্ষক অমি শ্রেষ্ঠ সবার 
দিল্লীর পতি সে তো কোন ছার, 
ভয় করি নাক, ধারি নাক ধার, মনে আছে মোর বল, 
বাদশাহ শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল 
যায় যাবে প্রাণ তাহে, 
প্রাণের চেয়েও মান বড়, আমি বোঝাব শাহানশাহে। 
তার পরদিন প্রাতে 
বাদশাহর দূত শিক্ষকে ডেকে নিয়ে গেল কেল্লাতে। 
শিক্ষকে ডাকি বাদশাহ কহেন,‘শুনুন জনাব তবে, 
পুত্র আমার আপনার কাছে 
সৌজন্যকি কি কিছু শিখিয়াছে? 
বরং শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা, 
নাহিলে সেদিন দেখিলাম যাহা স্বয়ং সকাল বেলা।’ 
শিক্ষক কন-‘জাহাপনা , আমি বুঝিতে পারি নে, হায়, 
কী কথা বলিতে আজিকে আমায় ডেকেছেন নিরালায়?’ 
বাদশাহ কহেন, ‘সেদিন প্রভাতে 
দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে 
নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন, 
পুত্র আমার জল ঢালিশুধু ভিজাইছে ও চরণ। 
নিজ হাত খানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে 
ধুয়ে দিল নাক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যাথা পাই মনে।’ 
উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষক তবে দাঁড়ায়ে সগৌরবে, 
কুর্ণিশ করি বাদশাহর তরে কহেন উচ্চরবে- 
‘আজ হতে চিরউন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির 
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।’ 

চাষী 
রাজিয়া খাতুন চৌধুরাণী 

সব সধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা, 
দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা। 
দধীচি কি তাহার চেয়ে সাধক ছিল বড়? 
পুণ্য অত হবে নাক সব করিলেও জড়। 
মুক্তিকামী মহাসাধক মুক্ত করে দেশ, 
সবারই সে অন্ন জোগায় নাইক গর্ব লেশ। 
ব্রত তাহার পরের হিত, সুখ নাহি চায় নিজে, 
রৌদ্র দাহে শকায় তনু, মেঘের জলে ভিজে। 
আমার দেশের মাটির ছেলে, নমি বারংবার 
তোমায় দেখে চূণ হউক সবার অহংকার। 

পাখি 
বন্দে আলী মিয়া
 

খাঁচার দুয়ার আলগা পাইয়া উড়ে গেছে পাখি বনে, 
ছোট কালো পাখি উড়ে গেছে দূর নীল নভ অঙ্গনে। 
শূন্য খাঁচাটি অনাদরে হোথা পড়ে আছে এক ধারে, 
খোকা বসি পাশে অশ্রুসজল চোক মোছে বারে বারে। 
একদা খোকন দূর দেশে গিয়ে এনেছিল এক পাখি, 
সারাদিন তারে করিত যতন সযতনে বুকে রাকি। 
ছোট কালো পাখি কুচকুচে দেহ-রেশম পালক তার, 
দুটি চোখে তার বনের স্বপন জাগে দূর পারাবার। 
এত ভালোবাসা, এতযে সোহাগ, পোষ তবু মানে নাই, 
খাঁচার প্রাচীরে পাখা ঝাপটিয়া, পথ খুঁজিয়াছে তাই । 
খোকা চায় পাখি - পাখি চায় বন-স্বাধীন মুক্ত প্রাণ, 
কন্ঠে তাহার জাগে ক্ষণে ক্ষণে নীল আকাশের গান। 
খোকা ভাবে মনে, এ পাখি তাহার-গান সে শোনায় তায় 
জানে না তো কভু কান্না তাহার সুর হয়ে বাহিরায়। 
গান শুনি তার মুগ্ধ হইয়া ভেবেছিল খোকা মনে- 
পোষ মানিয়াছে, ভুলে গেছে বন - রবে সে তাহার সনে। 
আদর করিয়া খাঁচার দুয়ার দিল একেবারে খুলি 
মন কভু কারো বশ নাহি মানে, সে কথা গেল যে ভুলি। 
সহসা পাখিটি কালে ডানা মেলি উড়ে গেল দূর দেশে, 
তারি শোকে আজ খোকার নয়ন অশ্রুতে যায় ভেসে। 


জোনাকিরা 
আহসান হাবীব
 

তারা একটি দুটি তিনটি করে এল 
তখন বিষ্টি-ভেজা শীতের হাওয়া 
বইছে এলোমেলো, 
তারা একটি দুটি তিনটি করে এল। 
থই থই থই অন্ধকারে 
ঝাউয়ের শাখা দোলে 
সেই অন্ধকারে শন শন শন 
আওয়াজ শুধু তোলে। 
ভয়েতে বুক চেপে 
ঝাউয়ের শাখা, পাখির পাখা 
উঠছে কেঁপে কেঁপে। 
তখন একটি দুটি তিনটি করে এসে 
এক শো দু শো তিন শো করে 
ঝাঁক বেঁধে যায় শেষে 
তারা বলেলে,ও ভাই ঝাউয়ের শাখা, 
বললে, ও ভাই পাখি, 
অন্ধকারে ভয় পেয়েছ নাকি? 
যখন বললে তখন পাতার ফাঁকে 
কী যেন চমকালে। 
অবাক অবাক চোখের চাওয়ায় 
একটুখানি আলো। 
যখন ছড়িয়ে গেল ডালপালাতে 
সবাই দলে দলে 
তখন ঝাউয়ের শাখায় পাখির পাখায় 
হীরে-মানিক জ্বলে। 
যখন হীরে-মানিক জ্বলে 
তখন থমকে দাঁড়ায় শীতের হাওয়া 
চমকে গিয়ে বলে- 
খুশি খুশি মুখটি নিয়ে 
তোমরা এলে কারা ? 
তোমরা কি ভাই নীল আকাশের তারা? 
আলের পাখি নাম জোনাকি 
জাগি রাতের বেলা, 
নিজকে জ্বেলে এই আমাদের 
ভালোবাসার খেলা 
তারা নইক নইক তারা 
নই আকাশের চাঁদ 
ছোট বুকে আছে শুধুই 
ভালোবাসার সাধ। 


দেশের জন্য 
সৈয়দ আলী আহসান
 

কখনও আকাশ 
যেখানে অনেক 
হাসিখুশি ভরা তারা, 
কখনও সাগর 
যেখানে স্রোতের 
তরঙ্গ দিশাহারা। 
কখনও পাহড় 
যেখানে পাথর 
চিরদিন জেগে থাকে, 
কখনও-বা মাঠ 
যেখানে ফসল 
সবুজের ঠেউ আঁকে। 
কখনও-বা পাখি 
শব্দ ছড়ায় 
গাছের পাতায় ডালে- 
যেসব শব্দ 
অনেক শুনেছে 
কোনও এক দূর কালে। 
সব কিছু নিয়ে 
আমাদের দেশ 
একটি সোনার ছবি 
যে দেশের কথা 
কবিতা ও গানে 
লিখেছে অনেক কবি। 
এ দেশকে আমি 
রাত্রি ও দিন 
চিরকাল ভালোবাসি 
সব মানুষের ইচ্ছার কাছে 
খুব যেন কাছে আসি। 
এ দেশকে নিয়ে 
আমার গর্ব 
প্রত্যহ চিরদিন, 
দেশের জন্য 
সবকিছু দিয়ে 
বাঁচব রাত্রিদিন। 


সবার আমি ছাত্র 
সুনির্মল বসু
 

আকাশ আমায় শিক্ষা দিল 
উদার হতে ভাই রে, 
কর্মী হবার মন্ত্র আমি 
বায়ুর কাছে পাই রে। 
পাহাড় শিখায় তাহার সমান- 
হই যেন ভাই মৌন-মহান, 
খোলা মাঠের উপদেশে- 
দিল-খোলা হই তাই রে। 
সূর্য আমায় মন্ত্রণা দেয় 
আপন তেজে জ্বলতে, 
চাঁদ শিখাল হাসতে মোরে, 
মধুর কথা বলতে। 
ইঙ্গিতে তার শিখায় সাগর- 
অন্তর হোক রত্ন-আকর; 
নদীর কাছে শিক্ষা পেলাম 
আপন বেগে চলতে। 
মাটির কাছে সহিষ্ণুতা 
পেলাম আমি শিক্ষা, 
আপন কাজে কঠোর হতে 
পাষাণ দিল দীক্ষা। 


সাইক্লোন 
শামসুর রাহমান
 

চাল উড়ছে, ডাল উড়ছে 
উড়ছে গরু, উড়ছে মোষ। 
খই উড়ছে, বই উড়ছে 
উড়ছে পাঁজি, বিশ্বকোষ। 

ময়লা চাদর, ফরসা জামা 
উড়ছে খেতের শর্ষে, যব। 
লক্ষ্মীপেঁচা, পক্ষীছানা 
ঘুরছে, যেন চরকি সব। 

মাছ উড়ছে, গাছ উড়ছে 
ঘূর্ণি হাওয়া ঘুরছে জোর। 
খাল ফুলছে, পাল ছিঁড়ছে 
রুখবে কারা পানির তোড়? 

হারান মাঝি, পরান শেখ 
বাতাস ফুঁড়ে দিচ্ছে ডাক। 
আকাশ ভেঙে কাচের গুড়ো 
উঠল আজান, বাজল শাঁখ। 

চম্পাবতির কেশ ভাসছে 
ভাসছে স্রোতে খড়ের ঘর। 
শেয়াল কুকুর কুঁকড়ো শালিক 
ডুবল সবি, ডুবল চর। 

No comments:

Post a Comment