Saturday, April 30, 2016

প্রথম শ্রেণী হতে মাধ্যমিক পর্যন্ত পাঠ্য সকল ছড়া ও কবিতার সংকলন-৩

হেমন্ত সুফিয়া কামাল 

সবুজ পাতার খামের ভেতর 
হলুদ গাঁদা চিঠি লিখে 
কোন পাথারের ওপার থেকে 
আনল ডেকে হেমন্তকে? 

আনল ডেকে মটরশুঁটি, 
খেসারি আর কলাই ফুলে 
আনল ডেকে কুয়াশাকে 
সাঁঝ সকালে নদীর কূলে। 

সকাল বেলায় শিশির ভেজা 
ঘাসের উপর চলতে গিয়ে 
হালকা মধুর শীতের ছোঁয়ায় 
শরীর ওঠে শিরশিরিয়ে। 

আরও এল সাথে সাথে 
নতুন গাছের খেজুর রসে 
লোভ দেখিয়ে মিষ্টি পিঠা 
মিষ্টি রোদে খেতে বসে। 

হেমন্ত তার শিশির ভেজা 
আঁচল তলে শিউলি বোঁটায় 
চুপে- চুপে রং মাখাল 
আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায়। 



স্বদেশ 
আহসান হাবীব 

এই যে নদী 
নদীর জোয়ার 
নৌকা সারে সারে, 
একলা বসে আপন মনে 
বসে নদীর ধারে 
এই ছবিটি চেনা। 
মনের মধ্যে যখন খুশি 
এই ছবিটি আঁকি 
এক পাশে তার জারুল গাছে 
দুটি হলুদ পাখি, 
এমনি পাওয়া এই ছবিটি 
করিতে নয় কেনা। 
মাঠের পরে মাঠ চলেছে 
নেই যেন এর শেষ 
নানা কাজের মানুষগুলো 
আছে নানান বেশ, 
মাঠের মানুষ যাই মাঠে আর 
হাটের মানুষ হাটে, 
দেখে দেখে একটি ছেলের 
সারাটা দিন কাটে। 
এই ছেলেটির মুখ 
সারা দেশের সব ছেলেদের 
মুখেতে টুক টুক। 

প্রার্থনা 
গোলাম মোস্তফা 

অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি 
বিচার দিনের স্বামী। 
যত গুণগান হে চির মহান 
তোমারি অন্তযামি। 

দ্যুলোক-ভূলোক সবারে ছাড়িয়া 
তোমারি চরনে পড়ি লুটাইয়া 
তোমারি সকাশে যাচি হে শকতি 
তোমারি করুনাকামী। 

সরল সঠিক পুণ্য পন্থা 
মোদের দাও গো বলি 
চালাও সে পথে যে পথে তোমার 
প্রিয়জন গেছে চলি। 

যে-পথে তোমার চির-অভিশাপ 
যে-পথে ভ্রান্তি, চির-পরিতাপ 
হে মহাচালক, মোদের কখনও 
করো না সে পথগামী। 

বঙ্গভূমি ও বঙ্গভাষা 
কায়কোবাদ 

বাংলা আমার মাতৃভাষা 
বাংলা জন্মভূমি। 
গঙ্গা পদ্মা যাচ্ছে ব’য়ে, 
যাহার চরণ চুমি। 
ব্রহ্মপুত্র গেয়ে বেড়ায়, 
যাহার পূণ্য গাথা! 
সেই-সে আমার জন্মভূমি, 
সেই সে আমার মাতা! 

আমার মায়ের সবুজ আঁচল 
মাঠে খেলায় দুল! 
আমার মায়ের ফুল বাগানে, 
ফুটছে কতই ফুল! 
শত শত কবি যাহার 
গেয়ে গেছে গাথা! 
সেই-সে আমার জন্মভূমি 
সেই-সে আমার মাতা! 

আমার মায়ের গোলা ছিল, 
ধন ধান্যে ভরা! 
ছিল না তার অভাব কিছু, 
সুখে ছিলাম মোরা! 
বাংলা মায়ের স্নিগ্ধ কোলে, 
ঘুমিয়ে রব আমি! 
বাংলা আমার মাতৃভাষা 
বাংলা জন্মভূমি! 

মুক্তির ছড়া 
সানাউল হক 
তোমার বাংলা আমার বাংলা 
সোনার বাংলাদেশ- 
সবুজ সোনালি ফিরোজা রুপালি 
রূপের নেই তো শেষ। 
আমি তো মরেছি যতবার যায় মরা, 
নবিন যাত্রী তমাকে শোনায় ছড়া। 
এদেশ আমার এদেশ তোমার 
সবিশেষ মুজিবের, 
হয়ত অধিক মুক্তিপাগল 
সহস্র শহীদের। 

বীরপুরুষ 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে 
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে। 
তুমি যাচ্ছ পাল্‌কিতে, মা চ’ড়ে 
দরজা দুটো এক্তুকু ফাঁক ক’রে, 
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার প’রে 
টগ্‌বগিয়ে তোমার পাশে পাশে। 
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে 
রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।। 
সন্ধে হল, সূর্য নামে পাটে, 
এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে। 
ধূ ধূ করে যেদিক পানে চাই, 
কোনখানে জনমানব নাই, 
তুমি যেন আপন মনে তাই 
ভয় পেয়েছ ভাবছ, ‘এলেম কোথা।’ 
আমি বলছি ‘ভয় করো না মা গো, 
ওই দেখা যাই মরা নদীর সোঁতা।’ 
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে- 
অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো। 
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে, 
‘দিঘির ধারে ওই-যে কিসের আলো!’ 
এমন সময় ‘হাঁরে রে রে রে রে’ 
ওই যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে? 
তুমি ভয়ে পাল্‌কিতে এক কোণে 
ঠাকুর দেবতা স্মরণ করছ মনে, 
বেয়ারাগুলো পাশের কাঁটাবনে 
পালকি ছেড়ে কাঁপছে থরোথরো। 
আমি যেন বলছি তোমায় ডেকে, 
‘আমি আছি, ভয় কেন, মা, করো!’ 
তুমি বললে ‘যাস্‌ নে খোকা ওরে,’ 
আমি বলি ‘দেখো-না চুপ করে।’ 
ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম তাদের মাঝে, 
ঢাল তলোয়ার ঝনঝনিয়ে বাজে, 
কী ভয়ানক লড়ায় হল মা যে 
শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা। 
কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে, 
কত লোকের মাথা পড়ল কাটা।। 
এত লোকের সঙ্গে লড়ায় ক’রে, 
ভাবছ খোকা গেলই বুঝি মরে। 
আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে 
বলছি এসে, ‘লড়ায় গেছে থেমে,’ 
তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে 
চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে 
বলছ, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল 
কী দুর্দশাই হতো টা না হলে!’ 


পারিব না 
কালীপ্রসন্ন ঘোষ 

পারিব না এ কথাটি বলিও না আর 
কেন পারিবে না তাহা ভাব একবার, 
পাঁচ জনে পারে যাহা, 
তুমিও পারিবে তাহা, 
পার কি না পার কর যতন আবার 
এক বারে না পারিলে দেখ শত বার। 
পারিব না বলে মুখ করিও না ভার, 
ও কথাটি মুখে যেন না শুনি তোমার, 
আলস অবোধ যারা 
কিছুই পারে না তারা, 
তোমায় তো দেখি না ক তাদের আকার 
তবে কেন পারিব না বল বার বার? 
জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার 
হাঁটিতে শিখে না কেহ না খেয়ে আছাড়, 
সাঁতার শিখিতে হলে 
আগে তবে নাম জলে, 
আছাড়ে করিয়া হেলা, হাঁট বার বার 
পারিব বলিয়া সুখে হও আগুসার। 


মা 
কাজী নজরুল ইসলাম 

যেখানেতে দেখি যাহা 
মা-এর মতন আহা 
একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই, 
মায়ের মতন এত 
আদর সোহাগ সে তো 
আর কোন খানে কেহ পাইবে না ভাই। 
হেরিলে মায়ের মুখ 
দূরে যায় সব দুখ, 
মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান, 
মায়ের শীতল কোলে 
সকল যাতনা ভোলে 
কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান। 

যখন জনন নিনু 
কত অসহায় ছিনু, 
কাঁদা ছাড়া নাহি জানতাম কোন কিছু, 
ওঠা বসা দূরে থাক- 
মুখে নাহি ছিল বাক, 
চাহনি ফিরিত শুধু মা’র পিছু পিছু! 

পাঠশালা হ’তে যবে 
ঘরে ফিরি যাব সবে, 
কত না আদরে কোলে তুলি’ নেবে মাতা, 
খাবার ধরিয়া মুখে 
শুধাবেন কত সুখে 
‘কত আজ লেখা হলো, পড়া কত পাতা?’ 
পড়া লেখা ভালো হ’লে 
দেখেছ সে কত ছলে 
ঘরে ঘরে মা আমার কত নাম করে! 
বলে, ‘মোর খোকামণি। 
হীরা মাণিকের খনি, 
এমনটি নাই কারো!’ শুনে বুক ভরে! 
দিবানিশি ভাবনা 
কিসে ক্লেশ পাব না, 
কিসে সে মানুষ হব, বড় হব কিসে; 
বুক ভরে ওঠে মা’র 
ছেলেরি গরবে তার 
সব দুখ সুখ হয় মায়ের আশিসে। 

কাজ্‌লা-দিদি 
যতীন্দ্রমোহন বাগচী 

বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই- 
মাগো, আমার শোলোক বলা কাজ্‌লা-দিদি কই? 
পুকুর ধারে, নেবুর তলে থোকায় থোকায় জোনায় জ্বলে,- 
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, একলা জেগে’ রই; 
মাগো, আমার শোলোক বলা কাজ্‌লা-দিদি কই? 

সে দিন হ’তে দিদিকে আর কেনই বা না ডাক, 
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো? 
খাবার খেতে আসি যখন দিদি বলে’ ডাকি, তখন 
ও-ঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো, 
আমি ডাকি,-তুমি কেন চুপটি করে’ থাক? 
বল্‌ মা, দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে? 
কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল-বিয়ে হবে! 
দিদির মতন ফাঁকি দিয়ে আমিও যদি লুকাই গিয়ে- 
তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে’ র’বে? 
আমিও নাই দিদিও নাই-কেমন মজা হবে! 

ভুঁইচাপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল, 
মাড়াস নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল; 
ডালিম গাছের ডালের ফাকে বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে, 
দিস না তারে উড়িয়ে মা গো, ছিঁড়তে গিয়ে ফল;- 
দিদি এসে শুনবে যখন, বলবে কী মা বল্‌! 

বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই- 
এমন সময়, মাগো আমার কাজলা দিদি কই? 
বেড়ার ধারে, ধারে পুকুর পাড়ে ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপে ঝাড়ে;- 
নেবুর গন্ধে ঘুম আসে না –তাইতো জেগে রই; 
রাত হ’ল যে, মাগো আমার কাজ্‌লা-দিদি কই? 


পাল্কীর গান 
সতেন্দ্রনাথ দত্ত 

পাল্কী চলে! 
পাল্কী চলে! 
গগন-তলে 
আগুন জ্বলে! 

স্তব্ধ গাঁয়ে 
আদুল গায়ে 
যাচ্ছে কারা 
রৌদ্রে সারা! 

ময়রা মুদি 
চক্ষু মুদি’ 
পাতায় ব’সে 
ঢুলছে ক’ষে। 

দুধের চাঁছি 
শুষ্‌ছে মাছি,- 
উড়ছে কতক 
ভনভনিয়ে। 
আস্‌ছে কারা 
হন্‌ হনিয়ে? 

হাটের শেষে 
রুক্ষ বেশে 
ঠিক দু’পুরে 
ধায় হাটুরে! 

কুকুর গুলো 
শুঁক্‌ছে ধূলো,- 
ধুঁক্‌ছে কেহ 
ক্লান্ত দেহ। 

গঙ্গা ফড়িং 
লাফিয়ে চলে; 
বাঁধের দিকে 
সুর্য্য ঢলে। 

পাল্কী চলে রে, 
অঙ্গ টলে রে! 
আর দেরি কত? 
আর কত দূর? 

জানাজানি 
আসাদ চৌধুরী 

বাংলাদেশের পাখি কেন মধুর সুরে ডাকে, 
জানো? 
জানি জানি জানি। 
পাখির ভাষার মান দিতে যে 
বাঙালি দেয় জান- 
পাখি যে তা জানে, 
তাইতো পাখি পাগল করে, 
বিহান বেলার গানে। 

বাংলাদেশের আকাশ কেন কপালে টিপ আঁকে, 
জানো? 
জানি জানি জানি। 
উদার আকাশ যে – ইসারায় 
ডাক দিয়ে যায় প্রাণে, 
বাঙালি তা জানে। 
তাইতো আকাশ টিপ দিয়ে যায়, 
ললাটের মাঝখানে। 

নিমন্ত্রণ 
জসীমউদ্‌দীন 

তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়, 
গাছের ছায়া লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়; 
মায়া মমতার জরাজরি করি 
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি, 
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভায়ের স্নেহের ছায়, 
তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়। 
ছোট গাঁওখানি- ছোট নদী চলে, তার একপাশ দিয়া, 
কাল জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া। 
ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী, 
পরের খবর টানাটানি করি; 
বিনাসূতী মালা গাঁথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া; 
বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তটের হিয়া। 
তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে ছোট সে কাজল গাঁয়, 
গলাগলি ধরি কলা বন যেন ঘিরিয়া রয়েছে তায়। 
সরু পথ খানি সূতায় বাঁধিয়া 
দূর পথিকেরে আনিছে টানিয়া, 
বনের হওয়ায়, গাছের ছায়ায়, ধরিয়া রাখিবে তায়; 
বুকখানি তার ভরে দেবে বুঝি মায়া আর মমতায়। 
তুমি যদি যাও- দেখিবে সেখানে মটর লতার সনে, 
সীম–আর-সীম – হাত বাড়ালেই মুঠি ভরে সেইখানে। 
তুমি যদি যাও সে – সব কুড়ায়ে, 
নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে, 
খাব আর যত গেঁয়ো চাষীদের ডাকিয়া নিমন্ত্রণে, 
হাসিয়া হাসিয়া মুঠি মুঠি তাহা বিলাইব জনে জনে। 


আসুন আজ আর এক বার সেসব ছড়া কবিতা গুলি পড়ি আর স্মরণ করি আমাদের ফেলে আসা সোনালী অতীতকে। 

No comments:

Post a Comment