Tuesday, May 10, 2016

রবীন্দ্র সঙ্গীত

মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান ।
মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটজূট,
রক্তকমলকর, রক্ত-অধরপুট,
তাপবিমোচন করুণ কোর তব
মৃত্যু-অমৃত করে দান ॥



আকুল রাধা-রিঝ অতি
জরজর,
ঝরই নয়নদউ অনুখন ঝরঝর–
তুঁহুঁ মম মাধব, তুঁহুঁ মম দোসর,
তুঁহুঁ মম তাপ ঘুচাও ।
মরণ, তু আও রে আও ।
ভুজপাশে তব লহ সম্বোধয়ি,
আঁখিপাত মঝু দেহ তু রোধয়ি,
কোর-উপর তুঝ রোদয়ি রোদয়ি
নীদ ভরব সব দেহ ।
তুঁহুঁ নহি বিসরবি, তুঁহুঁ নহি
ছোড়বি,
রাধাহৃদয় তু কবহুঁ ন তোড়বি,
হিয়-হিয় রাখবি অনুদিন
অনুখন–
অতুলন তোঁহার লেহ ।
গগন সঘন অব, তিমিরমগন ভব,
তড়িতচকিত অতি, ঘোর মেঘরব,
শালতালতরু সভয়-তবধ সব–
পন্থ বিজন অতি ঘোর ।
একলি যাওব তুঝ অভিসারে,
তুঁহুঁ মম প্রিয়তম, কি ফল
বিচারে–
ভয়বাধা সব অভয় মূর্তি ধরি
পন্থ দেখায়ব মোর ।
ভানু ভণে, ‘অয়ি রাধা,
ছিয়ে ছিয়ে
চঞ্চল চিত্ত তোহারি ।
জীবনবল্লভ মরণ-অধিক সো,
অব তুঁহুঁ দেখ বিচারি ।’





তোরা যে যা বলিস ভাই,
আমার সোনার হরিণ চাই ।
মনোহরণ চপলচরণ সোনার
হরিণ চাই ॥
সে-যে চমকে বেড়ায়, দৃষ্টি
এড়ায়, যায় না তারে বাঁধা ।
সে-যে নাগাল পেলে পালায়
ঠেলে, লাগায় চোখে ধাঁদা ।
আমি ছুটব পিছে মিছে মিছে
পাই বা নাহি পাই–
আমি আপন-মনে মাঠে বনে
উধাও হয়ে ধাই ॥
তোরা পাবার জিনিস হাটে
কিনিস, রাখিস ঘরে ভরে–
যারে যায় না পাওয়া তারি
হাওয়া লাগল কেন মোরে ।
আমার যা ছিল তা গেল ঘুচে
যা নেই তার ঝোঁকে–
আমার ফুরোয় পুঁজি, ভাবিস বুঝি
মরি তারি শোকে ?
আমি আছি সুখে হাস্যমুখে,
দুঃখ আমার নাই ।
আমি আপন-মনে মাঠে বনে
উধাও হয়ে ধাই ॥


ওগো শোনো কে বাজায়
বনফুলের মালার গন্ধ বাঁশির তানে মিশে যায়॥
অধর ছুঁয়ে বাঁশিখানি চুরি করে হাসিখানি--
বঁধুর হাসি মধুর গানে প্রাণের পানে ভেসে যায়॥
কুঞ্জবনের ভ্রমর বুঝি বাঁশির মাঝে গুঞ্জরে,
বকুলগুলি আকুল হয়ে বাঁশির গানে মুঞ্জরে।
যমুনারই কলতান কানে আসে, কাঁদে প্রাণ--
আকাশে ওই মধুর বিধু কাহার পানে হেসে চায়॥
রাগ: বেহাগ-কীর্তন
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1293
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1886
স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর



আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ।
খেলে যায় রৌদ্র ছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত ॥
কারা এই সমুখ দিয়ে আসে যায় খবর নিয়ে,
খুশি রই আপন মনে-- বাতাস বহে সুমন্দ ॥
সারাদিন আঁখি মেলে দুয়ারে রব একা,
শুভখন হঠাৎ এলে তখনি পাব দেখা।
ততখন ক্ষণে ক্ষণে হাসি গাই আপন-মনে,
ততখন রহি রহি ভেসে আসে সুগন্ধ ॥
রাগ: খাম্বাজ-কীর্তন
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১৭ চৈত্র, ১৩১৮
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1912
রচনাস্থান: শিলাইদহ
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর


তোমার প্রেম যে বইতে পারি
এমন সাধ্য নাই।
এ সংসারে তোমার আমার
মাঝখানেতে তাই
কৃপা করে রেখেছ, নাথ,
অনেক ব্যাবধান-----
দুঃখসুখের অনেক বেড়া
ধনজনমান।
আড়াল থেকে ক্ষণে ক্ষণে
আভাসে দাও দেখা-----
কালো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
রবির মৃদু রেখা।
শক্তি যারে দাও বহিতে
অসীম প্রেমের ভার
একেবারে সকল পর্দা
ঘুচায়ে দাও তার।
না রাখ তার ঘরের আড়াল,
না রাখ তার ধন,
পথে এনে নিঃশেষে তায়
কর অকিঞ্চন।
নাথাকে তার মান অপমান,
লজ্জাশরম ভয়------
একলা তুমি সমস্ত তার
বিশ্বভুবনময়।
এমন করে মুখোমুখি
সামনে তোমার থাকা,
কেবলমাত্র তোমাতে প্রাণ
পূর্ন করে রাখা,
এ দয়া যে পেয়েছে তার
লোভের সীমা নাই------
সকল লোভ সে সরিয়ে ফেলে
তোমায় দিতে ঠাঁই।


কোন্‌ খেলা যে খেলব কখন্‌ ভাবি বসে সেই কথাটাই--
তোমার আপন খেলার সাথি করো, তা হলে আর ভাবনা তো নাই ॥
শিশির-ভেজা সকালবেলা আজ কি তোমার ছুটির খেলা--
বর্ষণহীন মেঘের মেলা তার সনে মোর মনকে ভাসাই ॥
তোমার নিঠুর খেলা খেলবে যে দিন বাজবে সে দিন ভীষণ ভেরী--
ঘনাবে মেঘ, আঁধার হবে, কাঁদবে হাওয়া আকাশ ঘেরি।
সে দিন যেন তোমার ডাকে ঘরের বাঁধন আর না থাকে--
অকাতরে পরানটাকে প্রলয়দোলায় দোলাতে চাই ॥
রাগ: খাম্বাজ-বাউল
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ৫ ভাদ্র, ১৩২৯
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ২২ অগাস্ট, ১৯২২
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: সুভাষ চৌধুরী, অনাদিকুমার দস্তিদার, শান্তিদেব ঘোষ


তোর প্রাণের রস তো শুকিয়ে
গেল ওরে ।
তবে মরণরসে নে পেয়ালা
ভরে ॥
সে যে চিতার আগুন গালিয়ে
ঢালা, সব জ্বলনের মেটায়
জ্বালা–
সব শূন্যকে সে অট্টহেসে দেয়
যে রঙিন করে ॥
তোর সূর্য ছিল গহন মেঘের
মাঝে,
তোর দিন মরেছে অকাজেরই
কাজে ।
তবে আসুক-না সেই তিমির-
রাতি লুপ্তিনেশার চরম সাথি–
তোর ক্লান্ত আঁখি দিক সে
ঢাকি দিক্-ভোলাবার ঘোরে ॥



রাতে রাতে আলোর শিখা
রাখি জ্বেলে
ঘরের কোণে আসন মেলে

বুঝি সময় হল এবার আমার
প্রদীপ নিবিয়ে দেবার –
পূর্ণিমাচাঁদ, তুমি এলে ॥
এত দিন সে ছিল তোমার
পথের পাশে
তোমার দরশনের আশে ।
আজ তারে যেই পরশিবে যাক
সে নিবে ,যাক সে নিবে–
যা আছে সব দিক সে
ঢেলে ॥



এসো গো, জ্বেলে দিয়ে যাও প্রদীপখানি
বিজন ঘরের কোণে, এসো গো।
নামিল শ্রাবণসন্ধ্যা, কালো ছায়া ঘনায় বনে বনে॥
আনো বিস্ময় মম নিভৃত প্রতীক্ষায় যূথীমালিকার মৃদু গন্ধে–
নীলবসন-অঞ্চল-ছায়া
সুখরজনী-সম মেলুক মনে॥
হারিয়ে গেছে মোর বাঁশি,
আমি কোন্‌ সুরে ডাকি তোমারে।
পথে চেয়ে-থাকা মোর দৃষ্টিখানি
শুনিতে পাও কি তাহার বাণী–
কম্পিত বক্ষের পরশ মেলে কি সজল সমীরণে॥



দে পড়ে দে আমায় তোরা
কী কথা আজ লিখেছে সে ।
তার দূরের বাণীর পরশমানিক
লাগুক আমার প্রাণে এসে ॥
শস্যখেতের গন্ধখানি একলা
ঘরে দিক সে আনি ,
ক্লান্তগমন পান্থ হাওয়া
লাগুক আমার মুক্ত কেশে ॥
নীল আকাশের সুরটি নিয়ে
বাজাক আমার বিজন মনে ,
ধূসর পথের উদাস বরন মেলুক
আমার বাতায়নে ।
সূর্য ডোবার রাঙা বেলায়
ছড়াব প্রাণ রঙের খেলায় ,
আপন-মনে চোখের কোণে
অশ্রু-আভাস উঠেব ভেসে ॥



যে ফুল ঝরে সেই তো ঝরে, ফুল তো থাকে ফুটিতে--
বাতাস তারে উড়িয়ে নে যায়, মাটি মেশায় মাটিতে॥
গন্ধ দিলে, হাসি দিলে, ফুরিয়ে গেল খেলা।

ভালোবাসা দিয়ে গেল, তাই কি হেলাফেলা ॥
রাগ: পূরবী
তাল: একতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1291
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1885
স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী


এসো এসো পুরুষোত্তম , এসো
এসো বীর মম ।
তোমার পথ চেয়ে আছে প্রদীপ
জ্বালা ॥
আজি পরিবে বীরাঙ্গনার
হাতে দৃপ্ত ললাটে , সখা ,
বীরের বরণমালা ॥
ছিন্ন ক'রে দিবে সে তার
শক্তির অভিমান ,
তোমার চরণে করিবে দান
আত্মনিবেদনের ডালা–
চরণে করিবে দান ।
আজি পরাবে বীরাঙ্গনা
তোমার দৃপ্ত ললাটে , সখা ,
বীরের বরণমালা ॥



No comments:

Post a Comment